আমি এবং একাকীত্বঃ জাহিদুল ইসলামের ভাবনা
আমি এবং একাকীত্ব
জাহিদুল ইসলাম
"প্রত্যেকের বুকের নিভৃতে কিছু দগ্ধ ক্ষত থাকে লুকানো, কিছু অসম্পূর্ণ নির্মাণ, ভাঙাচোরা গেরস্থালী ঘরদোর, প্রত্যেকের নিজস্ব কিছু নিদ্রাহীন রাত্রি থাকে, যাকে চিরদিন নষ্ট নখের মতো রেখে দিতে হয় কোমল অনিচ্ছার বাগানে যাকে শুধু লুকিয়ে রাখাতেই সুখ, নিজের নিভৃতে রেখে গোপনে পোড়াতেই একান্ত পাওয়া"- কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ
একাকিত্ব , শব্দটা আজ আমার বড়ই চেনা। জীবনের কোনো না কোনো বাঁকে তার সাথে মুখোমুখি দেখা হয় আমার প্রত্যেক বেলাতে । আবার অনেকেই আছে, একাকিত্ব যাদের জীবনের সাথে জড়িয়ে গিয়েছে অঙ্গাঙ্গীভাবে। একাকিত্বই হয়ে উঠেছে জীবনের মূল সুর, সেই একাকিত্ব ঝড় আজ পাহাড়চূড়ায় বিস্তৃত রূপ লাভ করছে।
"ধ্রুপদী আঙিনা ব্যাপী কন্টকিত হাহাকার আর অবহেলা, যেন সে উদ্ভিদ নয় তাকালেই মনে হয় বিরান কারবালা এই সে একাকিত্ব।
মানুষ তার জীবনে যখন তখন একা হয়ে যেতে পারে, কিছু সময়ের জন্য। একা হওয়াটা খুব খারাপ কোন ব্যাপার না। আমার বাবা-মা আমাকে বাসায় একা রেখে কোথাও যেতে পারে, আমি রাস্তায় একা একা চলাফেরা করতে পারি, জীবনের কোন না কোন সময় একা হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। বরং কখনোই নিজেকে নিয়ে একা না থাকাটা বিরক্তিকর বা দম বন্ধকর মনে হতে পারে। সমস্যা হলো একা অনুভব করা - নিজেকে একা মনে হওয়া। সেটাই একাকিত্ব।
একাকিত্ব ভালো না,খারাপ?
একাকি জীবন বলেই এ সমাজের অনেক কিছু সে চিনতে পেরেছে, জেনেছে একা মানুষের সংগ্রাম কেমন। যদিও এ জীবনের শেষটুকু তার জানা নেই। হয়তো মৃত্যুতেই তার অবসান হবে।
কিন্তু জীবনের পথ চলাতে ‘আমার আমি’ কে আবিষ্কার করার এই মনোবাসনা অপূর্ণ রেখে পৃথিবীকে বিদায় নিতে চায় না একাকিত্ব।
তুমি আমার নিঃসঙ্গতার সতীন হয়েছ !বলে আখ্যায়িত করেছিল কবি এ একাকিত্ব কে।
এ একাকিত্ব কী তা আমি কিছুটা হলেও বুঝি
বিষাদ ছুঁয়েছে আজ, মন ভালো নেই, মন ভালো নেই; ফাঁকা রাস্তা, শূন্য বারান্দা সারাদিন ডাকি সাড়া নেই, একবার ফিরেও চায় না কেউ পথ ভুলকরে চলে যায়, এদিকে আসে না আমি কি সহস্র সহস্র বর্ষ এভাবে তাকিয়ে থাকবো শূন্যতার দিকে?
রোজকার অভ্যাসের ব্যতিক্রম কিছু ঘটলে মানুষের তার সাথে অভ্যস্ত হতে কিছুটা সময় লাগে। সময়টা নির্ভর করে অভ্যাসটা কতটা ব্যাপক আর প্রভাব বিস্তারকারী তার উপর। বড় ধরনের অভ্যাসের ব্যতিক্রম হলে তা মেনে নেয়া খুব কষ্টকর হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন একটা মানুষের জীবনে যখন দ্বিতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি থাকে, গভীর একটা সম্পর্ক তার জীবন জুড়ে থাকে, তখন সেই ব্যক্তি আর সম্পর্কও তার দৈনন্দিন অভ্যাসের একটা অংশ হয়ে যায়। তখন আর সেই ব্যক্তি আর সম্পর্ক ছাড়া নিজের জীবন কল্পনাও করা যায় না।
কিন্তু হঠাৎ করে যখন সেই মানুষটা জীবন থেকে হারিয়ে যায়, সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়, দৈনন্দিন জীবন থেকে অনেকটা অংশ কেমন যেন গায়েব হয়ে যায়, অনেকটা পেন্সিলে লেখা বাক্যের দু' -চারটিশব্দ ইরেজার দিয়ে মুছে ফেলার মতো। অনেকটা জায়গা ফাঁকা হয়ে যায় জীবনের বাক্যের মাঝে, হারিয়ে যায় তার অর্থ। হারাবেই তো; বাক্যের মাঝের দুটো দরকারি শব্দ হুট করে ফেলে দিলে কি আর বাক্যটার কোন অর্থ থাকে?
সারাক্ষণ মনে হতে থাকে কী যেন নেই, কে যেন নেই। অন্যদের দেখে মনে হয়, “আমার তো তাদের মতো আর কেউ রইলো না। আমি এখন কীভাবে থাকবো? আমার জীবন কীভাবে কাটবে তাকে ছাড়া?” কোন কিছুরই যেন আর কোন মূল্য নেই, কিছুতেই যেন আর কিছু এসে যায় না। জীবনটা কেমন যেন একরকম থেমেই যায়। হয় তো আশেপাশে আরও অনেকেই আছে, তার সাথে জড়িয়ে আছে আরও অনেক সম্পর্ক। কিন্তু সম্পর্কের সেই অভাবটা যদি অন্য সম্পর্কগুলো কিছুটা হলেও পূরণ করতে না পারে, বা ভুলিয়ে রাখতে না পারে, তখনই উঁকি দেয় সেই একাকিত্ব।
এ জগত সংসারে জীবনে নিজের জন্য যখন কিছুদিন থাকার ইচ্ছা পোষণ করল তখন সে দেখে, এতোটাই একা সে, তার আশপাশে সত্যিকারের আপন কেউ নেই। কিন্তু এতোদিন মনে হতো, কতজনই না তার জন্য আছে। যখন একান্ত মনের অনূভূতি নিয়ে কিছু প্রিয় মানুষের কাছে হাতটা বাড়িয়ে দিলো, ঠিক তখনই জানলো, কাউকে আপন করার সময় তার ফুরিয়ে এসেছে। সবাই যে বড় ব্যস্ত আপন জগতের। তার প্রতি যে দরদের আকুলতা তা বড্ড বেশী সাময়িক।
"এই শূন্য ঘরে, এই নির্বসনে কতোকাল, আর কতোকাল! আজ দুঃখ ছুঁয়েছে ঘরবাড়ি, উদ্যানে উঠেচে ক্যাকটাস্ত কেউ নেই, কড়া নাড়ার মতো কেউ নেই, শুধু শূন্যতার এই দীর্ঘশ্বাস, এই দীর্ঘ পদধ্বনি"।
একার মন চাইছে সমস্ত যন্ত্রণা থেকে মুক্তি নিয়ে সেই ছোটবেলার স্বপ্নকে আপন করে মুক্তচিত্তে পাহাড়, সমুদ্র বা অরণ্যে ঘুরে আসতে। কিন্তু এমন কল্পনার জগতে নাও ভাসাতে যে মানুষটি তার পাশে থাকবে বলে তার বিশ্বাস ছিল, সে আজ বলছে , ‘একা, এ তোমার কেমন পাগলামি।’ অথচ কত না দিন তারা গল্প করেছে এমন একটি সময়ের জন্য। ছিল না কোনো শর্ত কিংবা নিয়মের বাঁধন। তবে আজ কেন একা পাবে না তার নিজের জন্য একটু সময়?
"একা থাকার এই ভালো লাগায় হারিয়ে গিয়েছি, নিঃসঙ্গতা আমাকে আর পাবে না"
এমনি ভাবনাতে একার নিস্তব্ধ ঘরে রাতের আঁধারে কেটে যায় একাকি জীবনের আরো কিছু সময়। এক জীবনের একাকিত্ব সমাজের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ বা কটাক্ষ হয়। আরেক জীবনের একার একান্ত সময়ের একাকিত্ব শুধুই তার। তবে কি একার একাকিত্বের গল্পটা তার নিজের হয়েই থাকবে? যার সাক্ষী সে শুধু নিজেই?
আমার একাকিত্বের শেষ বেলা টা একটু ব্যাতিক্রম।আমি আমার একাকিত্ব দুই মিলে নতুন সংসার তবে আমার ভাগ্য খুব ভালো বলতে হবে যে আমাকে একাকিত্বের যন্ত্রণা খুব বেশি সময় সহ্য করতে হয় নি। আমার বাবা-মা আর বন্ধুরা আমাকে মাঝে-মাঝে একা থাকতে দিলেও একা অনুভব করতে দেয় নি। তাদের সঙ্গ, ভালোবাসা আর যন্ত্রণায় আমার জীবনের বাক্যের মুছে যাওয়া অংশের অনেকটাই নতুন শব্দ দিয়ে পূর্ণ করে দিয়েছে।
আজ আমি এবং একাকিত্ব নতুন সুরে গান গায়,যে গান আমার জীবনের বাক্যকে দিয়েছে নতুন অর্থ। সেই অর্থ আগের চেয়ে আরও উজ্জ্বল , আরও অনেক বেশি বিশুদ্ধ ।
তাই আজ আমি নতুন সুরে কবিতায়
একাকিত্বের ছন্দের ঝড় তুলি,
আমার স্মৃতিতে সেই প্রাচীন আবিষ্কারক
সেই একাকিত্বের শূন্যতা খাঁ খাঁ করে
চতু:সীমার সঙ্গে আমার সাতরঙা ইন্দ্রধনুর
সমাপ্তি,
দৃষ্টি বাইরে ভাঙ্গা মাস্তুুলে আড়ালে আমার আমিতে।
Comments
Post a Comment